WEST BENGAL ASSEMBLY ELECTIONS-2011

RE-ELECT ELECT LEFT FRONT GOVERNMENT OF WEST BENGAL FOR 8TH SUCCESSIVE TERM

Friday, July 12, 2013

PANCHAYAT ELECTION IN WEST BENGAL: ঘেরাটোপ, দেদার ছাপ্পার মুখেও লড়ে গেলো জঙ্গলমহলের গ্রাম

Ganashakti

চন্দন দাস

ঝাড়গ্রাম, ১১ই জুলাই — ছবি-(১), দুপুর ১২টা। মাওবাদী নেতা সিধু সরেনের ভাঙা শহীদবেদীর উপর দু’ পা তুলে বসেছিল অনন্য মাহাতো। উলটো দিকেই সেই চায়ের দোকান, যেখানে পাঁচজন সি পি আই (এম) কর্মীকে খুন করেছিল কিষানজীর দলবল। অনন্য জনসাধারণের কমিটির সংগঠক ছিল তখন। এখন ‘দিদি’-র ভক্ত। এদিন রামেশ্বরপুরে সিধুর শহীদ বেদীর উপর বসে বললেন,‘‘এখানে আমরা সবাই তৃণমূল। মাওবাদীরা ছিল। গেছে। সি পি এম-র সব ঘরছাড়া। জোড়াফুল ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছেন?’’

ঠিক তাই। রামেশ্বরপুর, হাতিলোট, দাসপুর — লক্ষ্মণপুরের জঙ্গলঘেরা শালবনীর এই একদা মাওবাদীদের নিশ্চিন্ত ডেরাগুলিতে এখন ঘাসফুলের অবাধ চাষ। কাছেই, চাষের জমির পাশে, যে স্কুলের চৌহদ্দিতে দাঁড়িয়ে সুজন মাহাতো প্রথমবার ভাষণরত কিষানজীকে দেখেছিলেন, সেখানে, রামেশ্বরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট হচ্ছিল। বাইরে তৃণমূলীদের দেদার ভিড়। তখনই ভোট দিয়ে ফিরে বছর পঁয়তাল্লিশের সুজন মাহাতো টানতে টানতে নিয়ে গেলেন একটি নির্মীয়মাণ একতলা বাড়ির সামনে। তারপর, তার সামনে দাঁড়িয়ে বর্তমানে তৃণমূলের একনিষ্ঠ কর্মী সুজন গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন,‘‘এই বাড়ি কিষানজী তৈরি করাচ্ছিলেন। আমি এটা বানাতে কাজ করেছি।’’

ছবি-(২), দুপুর সওয়া ১১টা। কী ভাবছেন? মাওবাদীদের অবাধ দৌরাত্ম্যের এলাকাগুলিতে তৃণমূলের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার বিবরণ লিখছি? একদম ঠিক। জঙ্গলমহলের এবারের ভোট প্রমাণ — যেখানে মাওবাদীরা ঘাঁটি গেড়েছিল, সেখানেই শেষ পর্যন্ত লালপতাকার সাময়িক সর্বনাশ করে মমতা ব্যানার্জির বাড়বাড়ন্তর পাকা সড়ক বানিয়ে দিয়ে গেছে মাওবাদীরা। লালগড়ের পূর্ণাপানি একটি উদাহরণ। এখানে বুথ দখল করেছে তৃণমূল। আর ধরমপুর — যেখানকার নেতা অনুজ পাণ্ডেকে ঘিরে এত ছিছিক্কার মিডিয়া, তৃণমূলের, সেখানে তৃণমূল, সি পি আই (এম) অবাধে বুথ অফিস করেছে, মানুষ ভোট দিয়েছেন। বাঁধগড়ার আল্পনা মাহাতো নিজের নাম জানতে গিয়েছিলেন তৃণমূলের বুথ অফিসে। তৃণমূল তাঁকে বামফ্রন্টের সমর্থক ভেবে নিয়ে বলেছে তোমার নাম নেই। আল্পনা এসেছেন বামফ্রন্টের বুথ অফিসে। বামফ্রন্ট কর্মীরা তাঁর নাম খুঁজে, হাতে স্লিপ ধরিয়ে পাঠিয়েছেন ধরমপুর স্টেট প্ল্যান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

ছবি-(৩), বিকাল সাড়ে ৫টা। গড়বেতা-১ নং ব্লকের জুনশোল প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটি আমলাগোড়া পঞ্চায়েতের মধ্যে। বুথের মধ্যে এক তৃণমূল কর্মী আর ধৈর্য ধরতে পারলেন না। একটি একটি ব্যালট ছেঁড়ার বদলে পুরো ব্যালট বইটিই ব্যাঙ্কের চেক বইয়ের মতো টেবিলের উপর রেখে পরপর ছাপ মারা শুরু করে দিলেন। ৭টা পর্যন্ত এমন চললো। কেন? কারণ ঐ বুথে দুপুর ৩টের পর আর গ্রামবাসীরা ভোট দিতে যাননি। কারণ, বুথের মধ্যে গোপনে ছাপ দেওয়ার জায়গায় এক তৃণমূল কর্মী দাঁড়িয়েছিলেন। সেই বীরপুঙ্গবকে দেখিয়ে ছাপ মারতে হচ্ছিল গ্রামবাসীদের। প্রিসাইডিং অফিসার, ভোটকমীরা বসেছিলেন ভ্যাবলার মতো। অবস্থা দেখে গ্রামবাসীরা আর ঐ প্রহসন কেন্দ্রের দিকে এগোননি। এমন ঘটনা কেশপুর, গড়বেতা, পিংলা, দাঁতনের বেশ কিছু জায়গায় হয়েছে এদিন। 

ছবি-(৪), দুপুর ১টা। এবার জাগতার সিংয়ের সঙ্গে আলাপচারিতা। অধিকাংশ পাঞ্জাবীদের মতো দিলদরিয়া মানুষ। বৃহস্পতিবারই বোঝা গিয়েছিল আধা সামরিক বাহিনীর হাল মমতা ব্যানার্জি কী বানাবেন। তাই হয়েছে। জাগতার সিং কী বলছেন শুনুন। কাঁটাপাহাড়ির ন্যাড়চার যে বুথে তৃণমূলের স্বার্থে মাওবাদীদের ‘ভোট বয়কট’-র ডাকে ২০০৯-র লোকসভা ভোটে একটিও ভোট পড়েনি, সেখানে এবার বিরাট লাইন। কাছেই মাওবাদী নেতা, নিহত লালমোহন টুডুর বাড়ি। তবে লালমোহন এখন প্রায় ভুলতে বসা একটি আবছা লোক — লোকটা যে একটা ‘বিরাট বিপ্লব’-র নামে পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে হাঙ্গামা করার মতো ঘটনা ঘটিয়েছিল — কে বলবে? কেউ তাঁর কথা বলছেও না। সেখানে ন্যাড়চা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন সি আর পি এফ-র ৫০ নং ব্যাটেলিয়নের এ এস আই জাগতার সিং। বললেন,‘‘চাকরি জীবনে এই প্রথম ভোট হলো আমার, যেখানে আমার কিছুই করার নেই। গাড়ি করে ঘুরে বেড়ানো আর রাস্তায় একটু হাঁটাচলা করা ছাড়া। বুথে দায়িত্ব নেই — এই প্রথম!’’ লালগড় থেকে রামগড়, বাঁশপাহাড়ি থেকে দহিঝুড়ি, ভীমপুর থেকে পীড়াকাটা — জঙ্গলমহলে সবচেয়ে বিপজ্জনক এই এলাকাগুলিতে এদিন আধা সামরিকবাহিনী মূলত জঙ্গলের শোভা, বৃষ্টির মাধুরী আর মানুষের আসা যাওয়া দেখে বিলকুল কাটিয়ে দিয়েছে। ধরমপুরে একটি সেতুর উপর দেখা রাজ্য পুলিসের এক এ এস আই যুবরাজ সরকারের সঙ্গে। বারাকপুর থেকে আসা রাজ্য পুলিসের ৬নং ব্যাটেলিয়নের এই কর্মীর দায়িত্বে ছিলেন আধা সামরিক বাহিনীর চারজন। এক জওয়ানকে প্রশ্ন করতেই রীতিমত হা হা করে ছুটে এলেন যুবরাজ। জীবনে বড়জোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নিরামিষ পোস্টিং পাওয়া যুবরাজ বললেন,‘‘আমাদের কাজ শুধু এই সেতুর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করা। গোলমাল হলে ছুটে যাওয়া আমাদের কাজ নয়। এরা আমার আন্ডারে।’’

স্পষ্ট যে — আধা সামরিক বাহিনীকে রাজ্য সরকারের ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা ছিল এদিনের ভোটের আর একটি বৈশিষ্ট্য।

ছবি-(৫), রাত ৯টা। কেশিয়াড়ির বেগমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তখনও ভোট চলছে। বুথের বাইরে প্রায় দুশো মানুষ। হঠাৎই তৃণমূল কর্মীরা বুথের ভিতর ঢুকে ভোট দেওয়া শুরু করে দিলেন। চললো ছাপ্পা। বাইরে অধীর ভোটদাতাদের চিৎকার। এমন ঘটনা যত রাত বেড়েছে, মমতা ব্যানার্জির পাঠানো ভোট কর্মী, প্রিসাইডিং অফিসারদের একাংশের কৌশলে ঘটেছে বিনপুর-২ নং ব্লকের এড়গোদা প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাজপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ঘটেছে আরো কিছু জায়গায়। 

কাঁকোর বড়াশুলি, কোরকোরা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির বুথে বামফ্রন্টের ভোটদাতাদের আটকানোর চেষ্টা করেছে তৃণমূল। কিছুটা সফল হয়েছে — কিন্তু পুরোটা নয়। ফলে যেখানে দলবল আছে, জঙ্গলমহলের সেখানেও বুথ দখল, ভয় দেখানো, মারধর, গ্রামবাসীদের আটকে রেখেছে তৃণমূল। বাইকবাহিনী প্রায় সর্বত্র গ্রামে গ্রামে ভয় দেখিয়েছে ভোটদাতাদের। তেমনই একটি বাইকবাহিনী গোয়ালডাঙ্গার কাছে এক গ্রামবাসীকে ধাক্কা মেরেছে। পুলিস বাইক আটক করেছে। তৃণমূলের কর্মী বুঝে ছেড়েও দিয়েছে। ধরমপুরের দামুজানায় সি পি আই(এম)-র এজেন্ট বিভূতি চালককে বেপরোয়া মারধর করেছে শাসক দল। তবে ওখানেই গ্রামবাসী মহিলারা তৃণমূলের কর্মীদের এমন দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদও করেছে। চন্দ্রকোনা টাউনে বামফ্রন্ট প্রার্থী স্বপন মূর্মু প্রহৃত হয়েছেন। 

তাছাড়া সদর ব্লকের কর্ণগড়, ধরমপুরের দামুজানা, বৈতার পলাশীতে গ্রামবাসীদের আটকে, বুথ জ্যাম করে জেতার চেষ্টা করেছে তৃণমূল। গোপীবল্লভপুরের ৯৮টি বুথের মধ্যে ৩০টি বুথ বিলকুল দখল করে নিয়েছে প্রাক্তন মাওবাদী, বর্তমানে তৃণমূলের কর্মীরা। ঐ ব্লকের তপসিয়া পঞ্চায়েতের কেন্দুয়ানা সংসদে সি পি আই(এম) প্রার্থী টোকন মুর্মুকে বেধড়ক মারধর করেছে তৃণমূল কর্মীরা। নয়াগ্রামেও গড়কেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়, দ্বারিকাপল্লী প্রভৃতি জায়গায় তৃণমূল বুথ দখল করে নেয় দুপুর ১টা নাগাদ। দেদার ছাপ্পা ভোট পড়েছে কেশপুর, গড়বেতার তিনটি ব্লকে, পিংলায়, ডেবরায়, দাঁতনে। গোপীবল্লভপুরের চর্চিতার এক সি পি আই(এম-এল) প্রার্থী জলেশ্বর বেরাকে মারধর করে তৃণমূল কর্মীরা।

বামফ্রন্ট কর্মীরা তবে কী করলেন? তাঁরা করেছেন তাঁদের কাজ, মাথা ঠাণ্ডা রেখে। বাঁশপাহাড়ির সমীর মাহাতো, মাণিকপাড়ার মহাশিস, ধরমপুরের বিনয় পাণ্ডে, গোপীবল্লভপুরের বিশ্বরঞ্জন – সবার মুখ রাত ৯টাতেও টানটান। তৃণমূল জখন বুথ দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে, এরা প্রত্যেকে বুথের দূরে দাঁড়িয়ে। একটিই লক্ষ্য। কী? চারজনেরই জবাব —‘‘আমাদের ভোটদাতাদের বুথের ভিতর পৌঁছে না দিয়ে ছাড়ছি না ময়দান। দেখি ওরা আর কী করে?’’ 

এটি ভোটপর্বের শেষ ছবি। কিন্তু আসলে ভোটপর্বের মূল ছবি।

- See more at: http://ganashakti.com/bengali/news_details.php?newsid=43571#sthash.oJqO7zdC.dpuf

No comments:

Post a Comment