N
‘মডেল’ ভেঙে পড়ার আশঙ্কাতেই এখনও নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে অবরুদ্ধ নন্দীগ্রাম
সুদীপ্ত বসু
নন্দীগ্রাম, ১১ই জুলাই— সেদিন ভাঙাবেড়া ব্রিজ সাক্ষী ছিল, নিরীহ মহিলা-শিশুদের পুলিসের সামনে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছিল তৃণমূল-মাওবাদী জোট। হলদি নদী দিয়ে এরপর অনেক জল বয়ে গেছে।
ছ’বছর পর নন্দীগ্রামের সোনাচূড়া, সেই ভাঙাবেড়া ব্রিজ, জেলিংহাম, তালপাটি খাল প্রমাণ করলো, আসলে কিছুই বদলায়নি।
তৃণমূলের দাবি, নন্দীগ্রাম ‘আন্দোলনের মডেল’। সেই ‘মডেল’ সেদিন পঙ্কজবালা সামন্তকে ছেলের পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া শরীর দেখার সুযোগ দেয়নি। আর আজ, এতদিন পরে ‘গণতন্ত্রে ভরপুর নন্দীগ্রামে’-এ এখনও সামাজিক বয়কটের ‘অভিশাপ’ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে সন্তান হারানো ওই জননীকে।
মোড়ে মোড়ে কতরকম নজরদারি পেরিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে এসে দাঁড়িয়েছিলাম ভাঙাবেড়া ব্রিজের উপরে। সেখান থেকেই দেখা গেলো, ওদিকে রাস্তার ধারে জ্বলজ্বল করে লেখা তৃণমূলী প্রার্থীর দেওয়াল লিখন, টাঙানো ফেস্টুন। প্রার্থীর নাম খোকন শিট।
আর ওই ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তেই পঙ্কজবালা সামন্তর ঘর। তাঁর আরও একটি পরিচয়। তিনি শঙ্কর সামন্তর মা। নন্দীগ্রামে নৈরাজ্যের আন্দোলনের একেবারে প্রথম পর্বে তৃণমূল-মাওবাদীদের হাতে খুন হন শঙ্কর সামন্ত। দিনটি ছিল ২০০৭ সালের ৭ই জানুয়ারি। ওইদিন সকালে তাঁর বাড়িতে জড়ো হয়েছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সশস্ত্র বাহিনী। ছিল ওই খোকন শিটও। ঘর থেকে বের করে টানতে টানতে প্রায় ২০০ মিটার দূরে নিয়ে গিয়ে প্রকাশ্যে রাস্তায় ব্যাপক মারধর করে, কুপিয়ে তাঁর বাড়ি থেকেই লুট করে নিয়ে আসা খড়ের গাদায় আগুন জ্বালিয়ে তাতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল শঙ্কর সামন্তকে। জঙ্গলমহলের ধরমপুরে সালকু সোরেনের মায়ের মতো সেদিন পঙ্কজবালা সামন্তও ছেলের মৃতদেহ দেখার সুযোগ পাননি।
ভাঙবেড়া ব্রিজ থেকে নেমে অনেক সন্দেহজনক চোখ এড়িয়েই মোরামের রাস্তা পেরিয়ে ঢুকতে হলো শঙ্কর সামন্তর বাড়িতে। ঘর তালাবন্ধ। গত ছ’বছরে খোলা হয়নি সেই ঘর। তাহলে কি কেউ নেই বাড়িতে? বেরিয়ে আসতে গিয়ে দেখা গেলো, পাশেই একটি ঘরের বেড়ার দরজার সামনে দাড়িয়ে রয়েছেন তিনি। আপনিই শঙ্কর সামন্তর মা? অঝোর কান্নায় মিললো উত্তর। তারপর নিজেই বললেন, আপনারা আমাদের বাড়িতে এসেছেন! চোখেমুখে বিস্ময়। কেন? পাঁচ-ছয় বছর পর কোনো ‘অতিথি’ যে পা রাখলো তাঁর দাওয়ায়।
কেন না শুভেন্দু অধিকারী থেকে শেখ সুফিয়ানদের ফতোয়া, এই বাড়িতে কেউ যেতে-আসতে পারবে না। চলছে তৃণমূলের একচ্ছত্র দাপটের নন্দীগ্রামে সামাজিক বয়কট। অনেক কথার মাঝেই সন্তানহারা ওই জননী বলছিলেন, চাষের জমি আছে, ছ’বছর বন্ধ। বাড়ির সামনে আগাছা, পোকামাকড়, সাপ, ব্যাঙ। তবুও পরিষ্কার করার জন্য কোনো লোক পাওয়া যায় না। যে আসবে এই বাড়িতে কাজ করতে, সে আর নন্দীগ্রামে কাজ পাবে না। ‘‘কেউ দিনের আলোয় আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারে না’’, বলছিলেন শঙ্কর সামন্তর মা।
একনাগাড়ে এই কথাগুলি শোনার পর আর যেন প্রশ্ন নেই। তাঁর চার ছেলে। এক ছেলের মৃত্যু হয়েছে অসুখে। বড় ছেলে শঙ্কর সামন্ত। মেজ ছেলে বাইরে রয়েছেন সংসার চালানোর তাগিদে। আর ছোট ছেলে নব সামন্ত এখন জেলে। ‘‘এখন মরণও আসে না। ছ’বছর ধরে বাড়ির বাইরে বেরোতে পারিনি’, বলে চলেন শঙ্কর সামন্তর মা।
ঘরেই দেখা মিললো শঙ্কর সামন্তর ভাইপো খেজুরির কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বরূপ সামন্তর। সেদিনের সকালের কথা মনে আছে? ‘‘হ্যাঁ। তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। সেদিন সকালে ওরা যখন হামলা চালালো বাড়িতে, তখন বাকিদের বাঁচাতে নব কাকার চার বছরের মেয়েকে হাঁড়িতে চাপিয়ে তালপাটিতে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। আমি, আমার মা সাঁতার কেটে তালপাটি পেরোই। আর ঠাকুমাকে কলার মান্দাসে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম।’’ তালপাটি পেরিয়ে সেদিন সবাই খেজুরিতে ঘরছাড়া শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
আর আজ? স্বরূপ বলছিল, ‘‘জানেন কতদিন পরে আমাদের বাড়িতে কেউ এলো।’’ কিছুদিন আগে পর্যন্ত বাজারহাটেও তাঁদের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল।
এই বয়কট, নজরদারির রাজনীতিই এখন তৃণমূলের সম্বল। নন্দীগ্রামে তৃণমূলের সর্বগ্রাসী দাপট। সিংহভাগ পঞ্চায়েত বিরোধীশূন্য। তারপরেও এত বাধা, নিষেধ, নজরদারি কেন রাখতে হচ্ছে নন্দীগ্রামকে?
উত্তর মিললো কংগ্রেস নেতা সবুজ প্রধানের কাছ থেকে। সেদিন ‘জমি আন্দোলনে’ তৃণমূলের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে ‘যুদ্ধ’ করেছিলেন। ছ’বছর পরে পঞ্চায়েত ভোটের চারদিন আগে নন্দীগ্রামের কংগ্রেস নেতা বলছেন, ‘‘নন্দীগ্রামের আন্দোলনকে নোংরা করে দিলো তৃণমূল। সারা দেশ জেনেছিল এই লড়াইয়ের কথা। এখন নন্দীগ্রামের কথা বলতে আমাদেরই লজ্জা হয়। তৃণমূল ছাড়া এখানে কারও কোনো স্বাধীনতা নেই।’’
নন্দীগ্রাম এখন এমনই। সোনাচূড়ার সাউদখালি অঞ্চলে তুহিন জানার মা ও দাদা দু’জনেই কংগ্রেস প্রার্থী। কংগ্রেসের কর্মী এই যুবক এদিন সকালে জানার মোড়ে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘‘দু’মিনিটের বেশি আপনার সাথে কথা বলতে পারবো না। চারদিকে অনেক চোখ রয়েছে। শুধু এটুকু জেনে রাখুন, কী অবস্থায় নন্দীগ্রামের মানুষ আছে, তা রাজ্যবাসী ভাবতেও পারবে না....।’’ বলেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন তিনি। সামনে দিয়ে ঠিক তখনই চারটে মোটরবাইক হু হু করে বেরিয়ে গেলো।
অদৃশ্য নজরদারি যে কতটা মারাত্মক, তা টের পাওয়া গেলো জেলিংহামে গিয়ে। জেলিংহামে ঘুরতে যাচ্ছি, এই বলেই যাওয়ার ছাড়পত্র মিলেছিল। হলদি নদীর পাড়ে এই বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গাতেই সেই সময় চলেছিল তৃণমূলের সহায়তায় মাওবাদীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির। হলদিয়া থেকে রিমোটে এই জেলিংহামেই রেলের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানার শিলান্যাস করেছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এখন সেই জেলিংহামের মাঠে গরু চড়ে। এখান থেকেই তৃণমূলী নেতাদের মারফত কোটি কোটি টাকার লোহার স্ক্র্যাপ চুরি করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল।
জেলিংহামের মতোই নন্দীগ্রামের হরিপুরে ‘কৃষক মাণ্ডি’র জন্য পাঁচিল দেওয়া জমি এখন গবাদি পশুর চারণভূমি। নন্দীগ্রামে উদ্বোধন হওয়া বিদ্যুতের সাবস্টেশন মানে নির্মীয়মাণ বাড়ি ও বেশ কিছু পোস্ট। তবে বিদ্যুতের তার এখনও যুক্ত হয়নি।
আর তাই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মাটিতে এখন হুমকি, হামলা, মিথ্যা মামলা দিয়ে নজর ঘোরাতে চাইছে শাসকদল। আজকের নন্দীগ্রামে কোথাও সি পি আই (এম)’র পতাকা টাঙাতে দেওয়া হয়নি। বাকিদেরও একই অবস্থা। প্রকাশ্যে প্রচার তো দূরঅস্ত।
নন্দীগ্রামের দু’টি ব্লকে শুধুমাত্র সি পি আই (এম) কর্মীদের বিরুদ্ধেই রয়েছে ৮৪০টি মামলা। যেমন ‘নন্দীগ্রাম মডেল’-এর মূল্য আজও গুনতে হচ্ছে প্রদীপ কাজলিকে। নন্দীগ্রাম-২ ব্লকে পঞ্চায়েতের বিদ্যুৎ কর্মাধ্যক্ষ, আমদাবাদ গ্রামের বাসিন্দা প্রদীপ কাজলি ছ’বছর ধরে ঘরছাড়া। এই মুহূর্তে তাঁর নামে ৭২টি মামলা রয়েছে। কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে বেকারিতে তৈরি রুটি দোকানে দোকানে বিক্রি করা, তারপরে হলদিয়া আদালতে গিয়ে নিয়ম করে হাজিরা দেওয়া, এই তাঁর দিনলিপি। সেখান থেকে ফিরে বিকেলে ফের টাকা তুলতে দোকানে দোকানে ঘোরা। প্রতিদিনের এই রোজনামচা। একমাত্র সন্তান রবীন কাজলি। যখন ঘর ছেড়েছিলেন, তখন সে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। এখন ভূগোলে স্নাতকোত্তর পড়ছে। ‘‘বাবাকে দেখে জেনেছি জীবন কী, বাবাই আমার কাছে লালপতাকার আকর্ষণ’’, জানালো রবীন।
হীরে-মুক্তোর থেকেও দামী এই কথাগুলিকেই এখন ভয় পান ‘নন্দীগ্রাম, জঙ্গলমহল করেছি’ বলে গর্বিত সাংসদ। ঘরছাড়া মানুষের সংখ্যা এখন প্রায় ২ হাজার ৭০০। কত শত নিদারুণ ঘটনা জড়িয়ে আছে ঘরছাড়া জীবনে। ছ’বছর ধরে সাউদখালির দিলীপ বেরা ঘরে ঢুকতে পারেননি। সব কিছু তছনছ হয়ে গেছে। স্ত্রী বাপের বাড়িতে। ছ’বছর ধরে যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে উন্মাদ হয়ে গেছেন। নন্দীগ্রামকে এই মূল্যও গুনতে হয়েছে।
নন্দীগ্রাম-১ ব্লকে ১৪৪টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে বামফ্রন্টের প্রার্থী ৯জন, পঞ্চায়েত সমিতির ৩০টির মধ্যে ৩জন আর জেলা পরিষদের তিনটিতেই প্রার্থী দিয়েছে বামফ্রন্ট। অবিশ্বাস্য সন্ত্রাসের মধ্যেই লড়ছেন ভেকুটিয়ায় বামফ্রন্ট প্রার্থী বছর চব্বিশের সোমা মাইতি।
এদিন সোমা বললেন, ‘‘অনেক কষ্ট করে লুকিয়ে প্রচার করছি, তবে শুনুন নন্দীগ্রামের মানুষ বুথ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে তৃণমূলের দুঃখ বাড়বে।’’
তাহলে কি তাসের ঘরের মতো সাধের ‘মডেল’ ভেঙে পড়ার আশঙ্কাতেই এখনও অবরুদ্ধ নন্দীগ্রাম?
- See more at: http://ganashakti.com/bengali/news_details.php?newsid=43573#sthash.hKSSiu38.dpuf
No comments:
Post a Comment